Title | : | ছবির দেশে, কবিতার দেশে |
Author | : | |
Rating | : | |
ISBN | : | - |
Language | : | Bengali |
Format Type | : | ebook |
Number of Pages | : | 332 |
Publication | : | First published January 1, 1991 |
কবি ও শিল্পীদের এই অমরাবতীতে একবার নয়, বারবার গিয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তার পাঁচবারের ভ্ৰমণ-অভিজ্ঞতা মিলিয়ে এই বই। সাধারণ ভ্ৰমণকাহিনীর থেকে এ-রচনার স্বাদ একেবারে আলাদা। নিছক ঘোরাফেরা আর দেখাশোনার মামুলী বৃত্তান্ত নয় এই বই। পুরো ফরাসীদেশটাকেই যেন খুঁড়ে-খুঁড়ে দেখা। তার শিল্প-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ঐতিহ্যের মধ্যে বিচরণ। শুধু এই শতকেই নয়, গত শতকেও। বিশেষ করে সেই সময়ে, যখন চিত্রশিল্পী ও কবিরা পারস্পরিক ঘনিষ্টতার মধ্য দিয়ে জড়িয়ে পড়ছেন নানান সৃষ্টিশীল আন্দোলনে।
স্বাভাবিকভাবেই এ-ভ্রমণকাহিনীতে এসে পড়েছে মার্গারিট নামে সেই ফরাসী বান্ধবীটির কথাও, প্রথমবার আমেরিকা-প্রবাসকালে যার সাহচর্য ফরাসীদেশকে গভীরভাবে জানতে সাহায্য করেছিল। মার্গারিটকে নিয়ে বহু গল্প-উপন্যাস লিখেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কিন্তু এই প্রথম মার্গারিটের সঙ্গে তাঁর গভীর অন্তরঙ্গতার আনুপূর্ব কাহিনী অকপটে বর্ণনা করলেন তিনি। এই ভ্ৰমণকাহিনীতে তাই টুকরো আত্মজীবনীরও স্বাদ। আর মাগারেটের সূত্রেই এই ভ্ৰমণকাহিনীতে এসেছে আমেরিকার বিটবংশ ও গ্রিনিচ গ্রামের কবিদের সঙ্গে তুমুল আড়ার স্মৃতি।
এ-গ্রন্থের প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতে রয়েছে বিখ্যাত একেকজন ফরাসী কবির কবিতা থেকে উদ্ধৃতি। এই অনুবাদের কাজে গদ্যলেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সহযোগী হয়েছেন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
ছবির দেশে, কবিতার দেশে Reviews
-
Midnight in Paris মুভিটি আমার ভীষণ প্রিয়। সেখানের মূল চরিত্র প্যারিসের রাস্তায় হেঁটে বেড়ায়, নিজের সঙ্গী হিসেবে কল্পনা করে নেয় ঐতিহাসিক সব লেখক-চিত্রশিল্পীদের! অনেক আগে দেখা সেই সিনেমা থেকে প্যারিসের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলাম।
তার অনেকদিন পর এই বই পড়লাম। সেই ভাললাগা আবার নতুনভাবেই জেগে উঠলো মনের মাঝে। এত সুন্দর করে লিখেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়! আমি যেন তাঁর সাথেই চলে গিয়েছিলাম প্যারিসের রাস্তায়!
পুরো বইয়ে বিভিন্ন খুঁটিনাটি বর্ণনা চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন তিনি। সত্যিই অসাধারণ!
মার্গারিটকে খুব ভাল লেগেছিল আমার। তাই তার শেষ পরিণতির রহস্যময়তা মনকে বিষণ্ণ করেছে। তার ছবিটার দিকে তাকিয়েছিলাম অনেকক্ষণ ধরে! কি সুন্দর সোনালী চুলের এক প্রাণবন্ত তরুণী!
বইয়ের প্রত্যেকটি অধ্যায়ের শুরুতে আছে চমৎকার কোন একটি ফরাসী কবিতার কিছু লাইন। কি দারুণ ব্যাপার!
সব মিলিয়ে খুবই ভাল কেটেছে ‘ছবির দেশে, কবিতার দেশে’ পড়বার পুরো সময়টা। :) -
এলেন গিন্সবার্গের কাছ থেকে যৌনমিলনের প্রস্তাব পাওয়ার পর সুনীলের জবাবটা আমাকে অবাক করেছে।
অন্তত বাংলাদেশের কোনো লেখককে নিজের জীবন বর্ণনায় এতোটা সৎ,মুক্তমনা এবং সাহসী হতে দেখি নি। -
ছবির দেশে, কবিতার দেশে সাধারণ একটা ভ্রমণকাহিনী-ই। লেখক বেশ কয়েকবার ফ্রান্স গিয়েছেন, তার ফ্রান্সের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমনের বর্ণনা। কিন্তু কিছু কারণে বইটা সাধারণ ভ্রমণকাহিনী হয়ে থাকেনি। হয়ে উঠেছে অনেকটাই অসাধারণ। যার প্রধান অবদান সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখনশৈলী ও বর্ণনাভঙ্গি। লেখার রসবোধ, স্পষ্ট বর্ণনার কারণে মনে হচ্ছিল সুনীল অ্যান্ড কোংয়ের সাথে আমিও ফ্রান্স ভ্রমণ করছি। একনাগাড়ে পড়া যায়নি বইটা। বেশ রয়েসয়ে, সময় নিয়ে উপভোগ করেছি।
বইটা শুধুই ভ্রমণকাহিনী নয়, এর আরেকটা কারণ হচ্ছে এতে উঠে এসেছে সুনীলের প্রথম যৌবনের প্রেমের কথা। ফরাসি রূপসীর সাথে সুনীলের দিনকাল পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে কোনো মিষ্টি প্রেমের উপন্যাস পড়ছি। এতে আরও রয়েছে বিষাদ, বিরহ, বিচ্ছেদ।
আমি শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকর্ম ও কবিতারও ভক্ত। এই লেখাতে সুনীল বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন ফ্রান্সের বিখ্যাত চিত্রকর, কবি ও সাহিত্যিকদের শিল্পকর্ম ও তাদের জীবনকে। ফরাসি কবিতা তো এই বইটার প্রাণ।
যাইহোক, ছবির দেশে কবিতার দেশে শেষপর্যন্ত ভ্রমণকাহিনী নয়, এটা হয়ত অনেকাংশে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজেই। -
সুনীলের সাথে ফ্রান্স ঘুরতে গিয়েছিলাম।ভ্রমণটুকু আরামদায়ক ছিল। বিস্তারিত পরে বলবো নে কোন একদিন।
-
ছবির মত সুন্দর এবং কবিতার মত প্রিয় বইটা আমি এতদিন পর পড়েছি বলে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। ফরাসি দেশ, কবি-শিল্পী, কবিতা-ছবি-ভাস্কর্য নিয়ে অন্য কোনো বাঙালি লেখক কতখানি লিখেছে জানি না; তবে সুনীলের এই বই পড়ে আমি যেমন অনেক অজানা কিছু জানতে পেরেছি তেমনি ফরাসি দেশও ভ্রমণ করে এসেছি চার বন্ধুর সাথে।
বই পড়ে শেষ করে ভ্রমণ শেষ হয়ে যাওয়ায় মন খারাপ লাগছে। আরেকটু দীর্ঘ করলে কি অপরাধ হতো। ফরাসি এত এত শিল্পী-কবিদের নামও জানতাম না। ফরাসি দেশের কবিতার সাথে আমার পরিচয় হল তাহলে। কিছু কিছু ছবি লেখকের বর্ণনার সময় কল্পনা করে নিয়েছি।
শার্ল বোদলেয়ারের এই কবিতা বড্ড ভাল লেগেছে -‘কাকে তুমি সবচেয়ে ভালোবাসো, হেঁয়ালি-মানুষ, আমায় বলো?
তোমার বাবা, মা, বোন, ভাইকে?
–আমার বাবা নেই, মা নেই, বোন নেই, ভাই নেই।
-তোমার বন্ধুদের?
-তুমি এমন একটা শব্দ ব্যবহার করেছ, যার অর্থ
আমি আজ পর্যন্ত বুঝিনি
-তোমার দেশ?
-কোন দ্রাঘিমায় তার অবস্থান আমি জানি না
-সৌন্দর্যকে?
-আমি আনন্দের সঙ্গেই তাকে ভালোবাসতাম, যদি হত সে
কোনও দেবী এবং অমর
-সোনা?
-আমি তা ঘৃণা করি, যেমন তুমি ঈশ্বরকে
-তবে, কী তুমি ভালোবাসো, অসাধারণ আগন্তুক?
-আমি ভালোবাসি মেঘ, যেসব মেঘেরা ভেসে যায়, ওই ওখানে…
ওই সেখানে…বিস্ময়ময় মেঘেরা!’
প্রতিটা শহর, জায়গা বর্ণনা করার সময় লেখক সে জায়গার ইতিহাসও খুব পরিষ্কার ভাবে সংক্ষিপ্তকারে বর্ণনা করেছে। কবি-শিল্পীদের জীবন নিয়েও কথা বলেছে। আমি জন্ম কবিতাপ্রেমী এজন্য বইটা আমার আজন্ম প্রিয় তালিকায় থাকবে।
মার্গারিট ম্যাতিউ এর মত শিল্পসাহিত্য পাগলিনীর সাথে পরিচয় না হলে সুনীলের এত সুন্দর সুন্দর লেখা হয়তো আমরা নাও পেতে পারতাম। মার্গারিটের সাথে সুনীলের লেখক জীবন এবং ফ্রান্সের প্রতি ভাল��বাসা সম্পূর্ণ জড়িয়ে আছে।
মজার ব্যাপার হল এই বইটা যখন পড়ছি তখন নেটফ্লিক্স ফিডে আমার চোখের সামনে কাকতালীয়ভাবে Emily in Paris টিভি শো চলে আসে। টিভি শো এবং এই বই একসাথে শেষ করেছি। আর ডুয়োলিংঙ্গোতে ফ্রেঞ্চ ভাষা শেখাও শুরু করেছি কিছুদিন আগে থেকে।
এমন একজন মার্গারিট ম্যাতিউ প্রয়োজন আমার জীবনে। ফ্রান্সে যদি কোনোদিন যাওয়ার সুযোগ হয় তবে ফ্রান্সে যেয়ে এই বইটা আবার পড়ব। ভাল থেকো মার্গারিট ম্যাতিউ, ভাল থেকো সুনীল। আমার বই পড়া জীবনে আসার পিছনে তোমার অবদান সবচেয়ে বেশি। ভালোবাসতে শিখিয়েছো তুমি। বিরহে ভাল থাকার ঔষধও দিয়েছ তুমি। ভাল থেকো। -
প্রথমবার পড়সিলাম যখন, আমি প্রবেশ করসিলাম ইমপ্রেশনিজ্মের একটা জগতে, প্রথমবারের মতো। পুরো অজানা একটা পৃথিবীর দরজা প্রথমবারের মতো খুলে গেসিলো, আর প্রথমবারের মতো একটা বোধ জন্মাইসিলো—যেই বোধ এখনো তাড়িত করে যাচ্ছে—art is always about breaking forms and looking beyond the boundaries।
কিন্তু এরপরেও, যেহেতু এই বার প্রথম বার না, এবং আমার গত কয়েক বছর ধরেই যেহেতু ক্রমাগত ওপরের দিকে তাকিয়ে যাচ্ছি—এই দ্বিতীয়বার পড়তে গিয়ে সূক্ষ্মতর কিছু অনুভূতি তাড়িত করলো। এই যেমন, বুদ্ধদেব বসু যে অনুবাদে ‘জ’ আর ‘ঝ’-এর মাঝামাঝি একটা উচ্চারণ লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে ‘জ’-এর নিচে ফোঁটা দেয়ার কথা ভাবসিলেন—শিহরিত হলাম পড়তে গিয়ে। কী প্রোগ্রেসিভ একটা মানুষ ছিলেন বুদ্ধদেব—আর কী সাহস!
গতবার ইমপ্রেশনিজ্ম প্রচণ্ড প্রভাবিত করসিলো। এবার, জানি না কেন, বোদলেয়ার আর আপোলিনেয়ার নিয়ে কৌতূহল হচ্ছে। আপোলিনেয়ারের সেই বৃষ্টি-কবিতা মনের গভীরে প্রভাবিত করসিলো অনেক—আমার ‘শাহরিক’ গল্পে সেটার প্রভাবও স্পষ্ট—কিন্তু এই দুই ব্যক্তিকে নিয়ে আমার ঘেঁটে দেখতে হবে।
ভাগ্যক্রমে, বোদলেয়ারর বাংলা অনুবাদ আছে—স্বয়ং বুদ্ধদেবের করা। যদ্দূর মনে পড়ে—নামটা ছিলো ‘ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল’।
হয়তো এখান থেকে শুরু করা যায়। -
অল্প কিছু খাবার থাকে যা একই সাথে সুস্বাদু আবার পুষ্টিকরও। এই বইটা অনেকটা সেইরকম।
প্রতি পরিচ্ছেদে অনূদিত কবিতাগুলোও কি চমৎকার। আমি যখন ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেই তখন আমার দিদি প্যারিসে গেছিলেন। সেই থেকে আমার খুব ইচ্ছা ওখানে যাবার, ল্যুভর দেখার। পরে আবার দেখেছিলাম 'Midnight In Paris' মুভিটা! এখন ইচ্ছা হয়েছে ফ্রান্সের রিভিয়েরা দেখার, লোয়ার নদীর তীরে শনসোসো প্রসাদ, শামবর শাতো দেখার, প্যারিসের রাস্তায় হেঁটে বেড়াবার।
আরো আগে পড়া উচিত ছিল বইটা। দৃষ্টিভঙ্গী, চিন্তা, রুচি উন্নত করবার মতন একটা বই। -
প্যারিস না দেখলেও ঠিক আছে কিন্তু এই বই না পড়লে জীবন বৃথা :)
-
সারাজীবনে মুষ্টিমেয় কয়েকখানা বই পড়েছি, আমার এই স্বল্প পড়া বইয়ের মধ্যে ভ্রমণ কাহিনী নেই বললেই চলে, কেন জানি আমাকে তা টানে না । কিন্তু এই বইটা পড়ার পর মনে হল আমাকে টানেনি কারণ আমি এই জানরার বইয়ের কাছেই যেতে পারিনি ভালোভাবে বেচারা টানবে কিভাবে।
“আমি খুলে ফেলি পোশাক ও টুপি সেই মুহুর্তে
বালির ওপর উলঙ্গ দেহে চিত্ হয়ে শুই
পুড়িয়ে প্রতীক্ষা করি, বেরুবে কখন
আমাদের এই চামড়ার নিচে লুকিয়ে যে আছে, সেই ভারতীয় ”।।
আর এই ভারতীয় শুধু বর্তমান ভারত নয় বরং সমগ্র ভারতবর্ষ । এই কবিতার মাধ্যমেই শুরু হয়েছে “ছবির দেশ কবিতার দেশ” বইটি। ছোটবেলায় জেনেছিলাম মিউজিয়ামের শহর প্যারিস, ছবির দেশ যে ফ্রান্স তা তো সবারই জানা আর এই ছবির ও কবিতার সেই স্বপ্নের ফরাসী দেশকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছে এই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসাধারন এই বইটি। বইটির সবগুলি অধ্যায় শুরু হয়েছে একজন করে ফরাসী বিখ্যাত কবির মনোমুগ্ধকর কবিতার উদ্ধৃতাংশ দিয়ে।
“বিদায় বিষাদ
স্বাগত বিষাদ
তুমি আঁকা আছো দেয়ালের কড়িকাঠে
তুমি আঁকা আছো আমার ভালবাসার চোখে
তুমি নও সম্পূর্ণ দুঃখ
কেননা দরিদ্রতম ওষ্ঠও তোমাকে
ফিরিয়ে দেয় এক টুকরো হাসিতে”।।
এদগার দেগা(
Edgar degas ), ক্লোদ মোনে(
Klod mone), মানে (
Edouard Manet), পল গগাঁ(
Paul Gauguin), অঁরি মাতিস(
Henri Matisse), রুয়ো(
Auguste Renoir), পিকাসো(
Pablo Picasso) এর মত জগৎবিখ্যাত চিত্রশিল্পীর জন্ম এই দেশে । তাছাড়া লিওনার্দো দা ভিঞ্চি(
Leonardo da Vinci) ও তো তাঁর শেষ জীবনটা এই দেশেই কাটিয়েছিলেন । শার্ল বোদলেয়ার(
Charles Baudelaire), রেনে শার(
René Char), লুই আরাগঁ(
Louis Aragon), আঁরি মিশো, জাক্ ওদিব্যারতি, সিরানো দ্য বারজেরাক(
Cyrano the Bergerac), সাঁ জন পার্স(
Saint john perse), রেনে গী কাদু, গীয়ম আপোলিনেয়ার(
Giom Apollinaire), পল এলুয়ার(Paul eluard), জাক প্রেভেয়(
Jacques prevert), পল ক্লোদেল(
Paul Claudel) এর মত মহান কবিদেরও এই ফ্রান্সই জন্ম দিয়েছে, করেছে লালন পালন । সেইসব মহান শিল্পী ও কবিদের নিয়ে এই বইটি যেন আরেকটি কবিতা ।
“সব সুন্দরেরই থাকে শুধু
একটিই বসন্ত
এসো , আমরা সময়ের পদচিহ্ন গুলিতে
পুঁতে দিই গোলাপ ”।।
মার্গারিট ম্যাথিউ নামের এক ফ্রান্সের এক সাতাশ বছর বয়সের তরুণীর সাথে পরিচয় হয় লেখকের আমেরিকায় । মার্গারিটের যেমন অনুরাগ ছিল ভারতীয় সংস্কৃতিতে তেমনি লেখকের ও আগ্রহ ছিল ফরাসী সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে। সেই পরিচয় ধীরে ধীরে গড়ায় প্রণয়ে । গোঁড়া ক্যাথলিক পরিবারের মেয়ে মার্গারিটের সাথে লেখকের প্রণয় কি শেষ হয় নি লেখকের কলকাতায় ফিরে আশার পরও, তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন মার্গারিটকে তিনি বাঁচিয়ে রেখেছিলেন এর এখন সেই দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছেন আমাদের মত পাঠকদের উপর ।
“বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীলপদ্ম
তবু কথা রাখে নি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ
এখনো সে যে-কোনো নারী!
কেউ কথা রাখে নি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখে না”!
আমি যখন সুনীলের কেউ কথা রাখেনি কবিতাটি পড়ি তখন আমার প্রত্যেক বারই মনে হয় এই বরুণা কি আমাদের হারিয়ে যাওয়া মার্গারিট । বইয়ের শেষ পাতা পর্যন্ত হাতড়ে বেড়িয়েছি মার্গারিটকে । তাছাড়া বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়ানোর কাহিনী মনে করিয়ে দেয় “অরণ্যের দিনরাত্রি”র কথা । যারা পড়েননি বইটি পড়ে ফেলুন আশা করি নিরাশ হবেন না। চিত্রকর ও কবিদের উইকি���িডিয়া লিঙ্ক দিয়েছি কেও যদি তাঁদের সম্পর্কে বিশদ জানতে চান ।
“সুন্দর দিনগুলি ,সময়ের ইঁদুরেরা চিবিয়ে খাচ্ছে
একটু একটু করে আমার জীবন
হা ভগবান ! এই বসন্তে প্রায় আঠাশ বছরে পৌছাবো
এর মধ্যেও অনেকটাই বাজে খরচ হয়ে গেছে , ইস্ !”
এই কবিতাটি পড়ার পর নিজের মনে একটাই প্রশ্ন জন্মেছিল, “কি করেছ বালক,বয়স তো তোমারও কম হয় নি ??”। যাই হোক শত কাজের মাঝেই একটু ফাঁকা সময় বের পড়তে হবে প্রচুর বই ।
-
ভবঘুরে সুনীল,একদিন আমেরিকার আয়ওয়া নামক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রোগ্রামে অংশ গ্রহণের সুযোগ পান।প্রচন্ড দুঃখে কষ্টে দিন কাটাতে থাকা সুনীলের জন্য এই বার্তা অনেকটা আশীর্বাদ হয়ে এল,কারন সে জীবনে প্রথমবার বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ পেল।তার বন্ধু বান্ধবদের সহায়তায় অনেক কষ্টে সুনীল পাড়ি জমালেন আমেরিকা, সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় কবিতা প্রেমী অনিন্দ্য সুন্দরী মার্গারেটের সাথে,পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব তারপর একসাথে দিন কাটানোর অনেক গল্প। মার্গারেটের সাথে পরিচয়ের সুবাদে সুনীল ফ্রান্সে যান এবং পুরো ফ্রান্স শহর সে ঘুরে দেখে দেখে,সেখানের শিল্প সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করে মার্গারেটের সাথে,সে সব কিছু চমৎকার বর্নণা আছে "ছবির দেশে কবিতার দেশে" বইটিতে।এছাড়াও, কলকাতা আসার পর সুনীল অনেকবার ফ্রান্স ভ্রমণ করেন, সে ভ্রমণের গল্পও চমৎকার ভাবে লিখেছেন বইটিতে।
আমার ভ্রমণ কাহিনি চমৎকার লাগে,তার উপর সেটা যদি হয় প্রিয় লেখকের বই তাহলে তো কথায় নেই।সুনীলের বর্ননার ভঙ্গি চমৎকার,সহজ সরল ভাষায় সব ঘটনার বর্ননা দেন।যাদের ভ্রমন কাহিনি প্রিয় তাদের জন্য অবশ্য পাঠ্য একটি বই। -
এই বইয়ের ব্যাপারে শ্রদ্ধাভাজন বড়ভাই প্রীতমদা'র একটা কথা কোট করি,
' এই মেলানকোলিক পিয়ানো পৃথিবীতে এই বইটা এক টুকরো সেপিয়া রঙের হাওয়াই মিঠাই। ' -
একবাক্য সুনীলের ম্যাগনাম ওপাস। অবশ্য পাঠ্য।
-
গোটা কয়েক দশক পেরিয়েছে উনিশ শতক। প্যারিসের একটি কাফে গেরবোয়া। বিকেল হলেই এখানে একে একে জড় হয় এক ঝাঁক শিল্পী, সাহিত্যিক আর সমালোচক। জমে ওঠে আড্ডা। সম্ভবত আধুনিক যুগ উত্তর সময়ের সেরা আড্ডা যা বদলে দেয় ভবিষ্যতের শিল্পের কাঠামো, সাহিত্যের ভাষা।
এই আড্ডায় আসতেন আধুনিক কবিতার প্রতিষ্ঠা পুরুষ শার্ল বোদলেয়ার। কবিতা যেন শত সহস্র বছর ধরে পথে চলছে একই সুরে। বোদলেয়ার সেই সুরটি বদলে দেন। এই আড্ডায় আসতেন শিল্পী এদুয়ার মানে। চালচলনে আপদমস্তক বুর্জয়া মানের তুলিতে উঠে আসে বিদ্রোহ। তাঁর ছবিগুলো প্রতিষ্ঠা করে দেয় বিখ্যাত ইমপ্রেসানিষ্ট আন্দোলনের প্রথম ইন্ধন। আরও আসতেন পল সেজান, এমিল জোলা, পিসারো, রেনোয়া, ক্লদ মোনে আর অসংখ্য অমর প্রতিভা।
শেষ করলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণমূলক এবং ভ্রমণ গ্রন্থ ছবির দেশে কবিতার দেশে। পৃথিবীর শিল্প আর সাহিত্যের রাজধানী ফ্রান্সে কাটানো সময়ের স্মৃতিবিন্দুগুলো জমিয়েছেন লেখক এখানে। প্রথমবার
ঘটনাক্রমে প্যারিস এসে লেখকের দেখা জুটলো না কিছুই। কিন্তু দ্বিতীয়বার প্যারিস ভ্রমণকে লেখক অমরত্ব দিতেই যেন লিখলেন এই বইটি। কারণ সেবার তাঁর সাথে ছিল মার্গারিট ম্যাতিউ।
সভ্যতার চূড়ার দেশ আমেরিকাতে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পেয়েও বাংলায় লেখার স্বপ্ন নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আবার বিমানে উঠলেন। কিন্তু মাঝপথে থামলেন প্যারিসে। সাথে ফ্রান্সের এক গ্রামের শিল্পবিলাসী মেয়ে মার্গারিট। মার্গারিটের সাথে লেখকের পরিচয় আমেরিকায়, কিন্তু চূড়ান্ত পরিনয় প্যারিসে। এই পরিণয় নিছক যৌবনের নয়, যৌনতারও নয়। এই পরিনয় কবিতার, শিল্পের, ইতিহাসের।
প্যারিসে রাজপথে, অলিগলিতে দুজনে কাটিয়েছে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। খেয়েছে সস্তার কোন কাফেতে, থেকেছে মার্গারিটে কোন বন্ধুর সৌজন্যে আশ্রয় দেয়া কোন এপার্টমেন্টে। ঘুরেছে মিউজিয়ার, সাতো, পার্ক আর নদীর পাশ দিয়ে। ষাটের দশকে প্যারিসের এই জুটির সময়ের কথা পড়লে মনে হয় আজ রাতেও প্যারিস গেলে হুট করে চোখে পড়ে যাবে ওদের। চিনতে পারব ঐ তো মার্গারিট আর সুনীল। দিনের বিশৃঙ্খল ঘোরাঘুরি শেষে অল্পদামের ওয়াইন আর বিরাট সাইজের একটা রুটি কিনে ফিরে যাচ্ছে অস্থায়ী আবাসে। ওদের তারুণ্য যেন থমকে আছে এই বইতে, থমকে আছে ষাটের দশকে প্যারিসের রাত, দিন, রোদ্দুর আর মেঘলা আকাশ।
ভূমিকায় বলা শিল্পীদের জীবন নিয়ে মার্গারিট সুনীলকে বলেছে টুকরো টুকরো ইতিহাস। কখনো ফরাসি বিপ্লবের, কখনো ১৮ বছর র্যাবোর সাহিত্য প্রতিভা, কখনো ইম্প্রেসানিস্ট শিল্পীদের তুলিতে বিদ্রোহ, আবার কখনো বাউন্ডুলে জা জেনের সন্ত হয়ে ওঠার গল্প। সুনীলকে আবৃত্তি করে শুনিয়েছি মার্গারিট প্রিয় কবি গীয়ম আপোলিনেয়ারের কবিতা। এসব যেন দূর কোন অতীতে নয়, বর্তমানেও নয়। তোলা আছে ভিন্নমাত্রিক এক সময়ে।
লেখাটা ছোট রাখতে গিয়েও বড় হয়ে যাচ্ছে। তবু শেষ করার আগে বলি, এটি শুধু ভ্রমণ আর স্মৃতিচারণের গ্রন্থ নয়, কবিতার গ্রন্থও বটে। প্রতি অধ্যায়ের মস্তকে রয়েছে একটি করে কবিতার অনুবাদ। পাঠক আপনি যদি সেই কবিতাটির সঙ্গে অধ্যায়টির যোগসূত্র না খুঁজে পান কিংবা না খোঁজার চেষ্টা করেন, জানবেন আপনার পড়া অসম্পূর্ণ। -
এক ঝটকায় যেন ফ্রান্সে ঘুরে এলাম। পথেই যাত্রা শুরু পথেই শেষ! রেশ থাকবে বহুদিন।
-
যতক্ষণ মার্গারিট ছিলো, ততক্ষণ অনেক প্রাণবন্ত লাগছিলো। মার্গারিট হারিয়ে যেতে যেতে সেই প্রাণটাও যেনো একটু একটু করে হারিয়ে গেলো।
-
সত্য সবসময়ই সুন্দর। অকপটতা থেকে যেন ঠিকরে বের হয় সৌন্দর্য। বাংলা সাহিত্যে প্রেম আর যৌবনের উদ্দামতা নিয়ে এমন অকপট সত্য প্রকাশের সাহস খুব কম লেখকেরই আছে। তাইতো এই ভ্রমণকাহিনীও হয়ে ওঠে প্রেমময়।
কোন জায়গার ইতিহাস কিংবা ছবির বর্ণণা পড়ে মনে হয় স্থানীয় অভিজ্ঞ ট্যুরিস্ট গাইডের কথা শুনছি। মনে হয় নিজেই বুঝি সুনীলের সহযাত্রী হয়ে ঘুরছি আইওয়া কিংবা প্যারিসের পথে। মনে হয় যেন আমারই না-বলা অনুভূতিগুলো সুনীল কীভাবে যেন আগেই জেনে গেছেন, লিখে গেছেন বইয়ের পাতায়। মনে পড়ে প্রথমবার শান-বাঁধানো সাগর-পাড় দেখে কী কষ্টই না পেয়েছিলাম, ঠান্ডায় বরফ হয়ে যাওয়া নদীর উপর হাঁটার সময় কী এক অদ্ভূত অনুভূতিই না হয়েছিল, ভ্রমণের খরচ কমানোর সে কী প্রচেষ্টাই না থাকে আমাদের, আর কী অভিভূতই না হই সুন্দর-সুন্দর জায়গা দেখে। এই ছোট-ছোট গভীর অনুভূতিগুলোইতো ভ্রমণকে স্মরণীয় করে রাখে। আর ভ্রমণকাহিনীর সাথে কবিতাগুলো বইটাকে নিয়ে গেছে অন্য এক স্তরে। বইটি তাই সরাসরি ঢুকে গেছে প্রিয় বইয়ের তালিকায়। -
ছবির দেশ কবিতার দেশ। রোমের সাহিত্যবিপ্লব, নেদারল্যান্ডস এর চিন্তাবিপ্লব, ইতালির স্থাপত্যবিপ্লব সব এসে জড়ো হলো প্যারিসে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, ভলতেয়ার, বোদলেয়ার, জ্যা রুশো, রেনোয়ার মতো শিল্পী আর কবিতে প্যারিস হয়ে উঠলো শিল্প আর সাহিত্যের রাজধানী।কথিত আছে, বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের কড়া নির্দেশ ছিলো, প্যারিসে বোমা ফেলা যাবে না।
এই প্যারিস নিয়েই সুনীল লিখলেন ছবির দেশে কবিতার দেশে।
ভ্রমণকাহিনী বলবো নাকি টাইম মেশিন বলবো? লেখক ফ্রান্সের একেক শহরে গেছেন আর সেই শহরের সাহিত্যের ইতিহাস পাঠকের সামনে তুলে এনেছেন। সাথে ছিলো ফরাসি বিপ্লব আর রাজনীতির ছোট্ট একটা অংশ।
প্যারিসের মিউজিয়াম বা ফ্রান্সের ঝলমলে রাস্তা দেখে লেখক যেমন মুগ্ধ হয়েছেন, তেমনি এটাও মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি যে, এই প্রাচুর্য ফরাসিরা আফ্রিকা থেকে লুট করে নিয়ে এসেছিল। আজকের আলো ঝলমলে প্যারিসের পেছনে আছে আফ্রিকা থেকে লুট করা সম্পদ, দাস ব্যবসা থেকে পাওয়া বিপুল অর্থ।
পুরো বইতে লেখক আর ফ্রান্সের সাথে ছিলেন আরো একজন। মার্গারিট।
পল অ্যাঙ্গেলের আমন্ত্রনে লেখক যখন আমেরিকায়, তখন মার্গারিট নামের এক ফরাসি মেয়ের সাথে লেখকের পরিচয় হলো। একদিকে তীব্র সাহিত্য প্রেমের উদার একজন নারী অন্যদিকে লেখকক��� চুমু খেতে অস্বীকৃতি জানানো ক্যাথলিক, মার্গারিটের মধ্যে আমরা এক অদ্ভুত চরিত্রের সন্ধান পাই।
মার্গারিটের মধ্যে এক মমতাময় বাঙালি নারীকেই আমি খুঁজে পেয়েছিলাম। সম্ভবত লেখকও খুঁজে পেয়েছিলেন। তাইতো বাঙালি এক লেখক মন দিয়ে বসলেন মার্গারিট নামের এক ফরাসি কন্যাকে। আমেরিকার নিরাপদ জীবন পায়ে ঠেলে মার্গারিটের কাছে প্যারিসে ছুটে গেলেন। প্যারিসের রাস্তায় চললো ফরাসি সাহিত্যের পাঠ। স���নীল তখন মনোযোগী ছাত্র, মার্গারিট কড়া মাস্টার। কখনও সে পাঠের অনুষঙ্গ লুভ্যর মিউজিয়াম, কখনও লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির কোনো চিত্র কখনও বা বোদলেয়ারের কবিতা।
প্যারিসের প্রথম পাঠ চুকিয়ে সুনীল মার্গারিট দুদিকে চললেন। দুজনের দুটি পথ দুদিকে বেঁকে গেল। কথা ছিলো নিয়মিত যোগাযোগ হবে। হলো না। একদিন মার্গারিট সুনীলের জীবন থেকে হারিয়ে গেলেন।
মার্গারিট ছাড়লেও প্যারিস সুনীলকে ছাড়লো না। ইউরোপ আমেরিকায় যতবার গেছেন, ততবারই প্যারিসটাকে একবার ছুঁয়ে আসতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
ছবির দেশ কবিতার দেশ বারবার যাওয়ার কারণ কী ছিলো? বোলদেয়ারের কবিতা নাকি মার্গারিটের স্মৃতি, কোনটা সুনীলকে প্যারিসে টেনে নিয়ে গেছে বারবার? এ প্রশ্নের জবাব আমি পাইনি এখনও। -
বইটা একটু পড়ে রেখে দিই,আবার পড়ে রেখে দিই।এত সুন্দর বই। মনে হচ্ছিল আমিও ঘুরে আসলাম ফ্রান্স,প্যারিসের রাস্তা যেন আমিও চষে বেড়াচ্ছিলাম। কখনো প্যারিস যাওয়া হলে সত্যিই এই বইটার কথা মনে পরবে,মার্গারিটের জন্য মন কেমন করবে ♥
যদি কখনো তোমার আমার ফ্রান্স যাওয়া হয়, আমি তোমার মার্গারিট হলে তুমি কি আমার সুনীল হবে?
বছরের প্রথম বই ♥ -
Midnight in Paris দেখে প্যারিসের প্রেমে পড়া আমি "ছবির দেশে কবিতার দেশে " পড়ে এখন রীতিমতো ঘুমের মাঝে প্যারিস নিয়ে স্বপ্ন দেখতেছি!
মার্গারিট এর এমন নাই হয়ে যাওয়া মেনে নিতে এখনো কষ্ট হচ্ছে! -
কখনও কখনও এই বইটা মন খারাপের সঙ্গী, কখনও কখনও স্বপ্নের। যে জীবন সুনীলের, মার্গারেটের প্রার্থনা করি তার সাথে যেন হয় আমার দেখা।
-
'যে শিশু মানচিত্র ও প্রতিলিপি ভালোবাসে
তার কাছে এই বিশ্ব তার ক্ষুধার মতই প্রকান্ড
ওহ, প্রদীপের আলোয় কতই না বিশাল এই পৃথিবী
স্মৃতির চোখে এই পৃথিবী কতই না ছোট!'
শুরু করলাম 'চার্লস বেদলোয়া'র লেখা কবিতার কটা লাইন দিয়ে, নাহ কবিতা আমার পড়া হয়নি। সুনীলের অনুবাদে কবিতার এটুকু পড়লাম 'ছবির দেশে কবিতার দেশে' বইয়ে। আসলে ছবি বা পেইন্টিংতো লিখে দু'কথায় বর্ণনা করা সম্ভব না, তাই কবিতা দিয়েই শুরু করতে হল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে একটা ইন্টারভিউতে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি ঔপন্যাসিক নাকি কবি! তার সৃষ্টি যদি পাঠক মনে ছাপিয়ে থাকে, তবে সেটা উপন্যাস বেশি। হ্যাঁ, তার লেখা কবিতাও জীবন্ত-সজীব। তবুও সুনীল বলেছিলেন, তিনি নিজেকে কবি ভাবতে ভালবাসেন। এমন কবির কাছে কবিতা যে আলাদা ও বিশেষ কিছু, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বলা চলে, 'অর্ধেক জীবন' বইটি যদি সুনীলের জীবনের প্রথম অংশ হলে 'ছবির দেশে কবিতার দেশে' বইটি তার বাকী অর্ধেকের আত্মজীবনী। তবে আমি বলব ভিন্ন কথা, বইটি শুধু আত্মজীবনী নয়। বইটি কাব্য, অনুবাদ, প্রবন্ধ আলোচনা অথবা নিখাঁদ খাঁটি একটা উপন্যাস; যে নামেই প্রকাশ করবেন, অপূর্ণ থেকে যাবে।
শুধু 'ছবির দেশে কবিতার দেশে' নিয়ে সংক্ষেপে রিভিউ লেখা সম্ভব নয়। নাম শুনে বলার অপেক্ষা রাখেনা ছবির দেশ বলতে আমরা প্রথমে ফরাসী দেশ পরে সমগ্র ইউরোপকেই বুঝি। সতেরো শতকের শুরু থেকে ইউরোপে যে শিল্প বিপ্লব শুরু হয়েছিল 'ছবির দেশে কবিতার দেশে'র ভাষায় সেটা শিল্প সাহিত্যের বিপ্লব। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বইটিতে তুলে ধরেছেন তার জীবদ্দশার পাঁচবার ইউরোপ তথা ফ্রান্স ভ্রমণের কাহিনী; যদিও তিনি বইটির শুরুতে বিশাল অংশ জুড়ে বর্ণনা করেছেন তার আমেরিকার প্রবাস জীবনের গল্পও। নিজের কথা বলার সাথে সাথে বইটির দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র সুনীলের ফরাসী বান্ধবী মার্গারিট ম্যাথিউ। হ্যাঁ, মার্গারিট ম্যাথিউ এসেছে সুনীলের লেখা বেশ কয়েকটি বইয়ে। তবে 'ছবির দেশে কবিতার দেশে'র মার্গারিটকে তিনি তুলে ধরেছিলেন অন্তরঙ্গ জীবনের নিক্তিতে। অকপটে বলেছেন মার্গারিটের সাথে তার স্মৃতির গল্প। বিশ্বাস করুন, এমন সমৃদ্ধ একটা উপন্যাসের একটা পর্যায়ে মার্গারিট বিষয়টা আপনাকে থমকে দেবে। আপনি আবেগি হলে কাঁদতেও পারেন।
'ছবির দেশে কবিতার দেশে' বইটি পড়ার আগে নিজেকে কিঞ্চিৎ পড়ুয়া দাবী করতাম। কয়েকবার পড়ার পরে এখন চিত্রশিল্প প্রেমীও দাবী করতে পারি। একটা বই যে কখনো একটা ক্লাস রুম হয়ে ওঠে, এই বইটি তারই নিদর্শন। আপনি যখন ভ্রমণ পড়বেন, খেয়াল করবেন লেখক তার ভ্রমণ কেচ্ছাকে সাহিত্যের স্বরে বর্ণনা করেছেন। অথবা স্থানীয় সংস্কৃতির মিশেলে গল্প সাজিয়েছেন। বইটিতে সুনীল সে পথে হাটেননি। শেষের চারবারের ভ্রমণের যে বর্ণনা তিনি করেছেন, তাতে তিনি কখনো গদ্যকার, কখনো কবি, আবার কখনো শিল্পীর গভীর জায়গা থেকে এমনভাবে লিখেছেন আপনার কাছে মনে হবে যেন ওই ভ্রমণে সুনীলের সাথে আপনিও সহযাত্রী ছিলেন। আমেরিকা সফরে বান্ধবী মার্গারিটের কাছ থেকে ফরাসী ভাষা, শিল্প ইতিহাস সম্পর্কে গভীর তথ্য সমৃদ্ধ হয়েছিলেন; তারই মিশেলে পরবর্তী চারবার ভ্রমণের চিত্রে ছিল গভীর ছোঁয়া। প্রতিবার ভ্রমণে বিষয়ভিত্তিক বর্ণনার সাথে সাথে ইতিহাস তুলে ধরেছেন গভীরভাবে। ঠিক এ কারণে প্রত্যন্ত 'লুদ' গ্রামে যদি কোন কারণে আপনার যাত্রা থমকে, তবে অবশ্যই ভাবতে বাধ্য হবেন বইটির কথা। আমেরিকায় হারিয়ে যাওয়া এই গ্রামের মেয়ে 'মার্গারিট' এর কথা। যার কাছে প্রেম ছিল পবিত্র, ভালবাসা ছিল অনেকটা ধর্মীয় সাধনার মত। তা সে যত কঠিনই হোক। ওই যে বইটিতে 'জ্যাক প্রেড' বলেছিলেন!
'লোহার বাজারে গিয়েছি আমি
শিকল কিনেছি,
কঠিন শিকল।
তোমারি জন্য, হে আমার প্রেম।'
কাহিনিঃ
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ষাটের দশকে জীবনের প্রথম পাসপোর্ট বানিয়ে উড়াল দিয়েছিলেন আমেরিকাতে। আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পল এঙ্গেল বিদেশী ভাষা নিয়ে কাজ করার জন্য সারাবিশ্ব থেকে ক্রিয়েটিভ রাইটার নিচ্ছিলেন, আর সে দলেই ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কোলকাতা, চাইবাসা-সাওতাল পরগণার বাইরেও যে চমৎকার পৃথিবী রয়েছে সেটাই কাছ থেকে দেখা শুরু হয় তার আমেরিকা প্রবাসজীবনে। আইওয়া শহরের শ্বেতাঙ্গ স্বর্ণকেশীদের ভিড়ে কিঞ্চিৎ ভিন্ন চেহারার এক নারীকে আবিস্কার করেছিলেন সুনীল, হ্যাঁ এটাই মার্গারিট। যাকে চুমু খেতে চাওয়ার অপরাধে দীর্ঘ দিন বিচ্ছেদ মানতে হয়েছিলো। মার্গারিট বিশ্বাস করে, চুমু ভালবাসার অংশ। ভিন্ন ধর্মের একটা ছেলের সাথে এই অনুভূতি বিনিময়ের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। যদিও পরে সুনীলের সাথে সম্পর্ক গড়ে! সম্পর্কের আবর্তেই সুনীল জানতে পেরেছেন ফরাসী দেশ সম্পর্কে, সমগ্র ইউরোপের শিল্প সাহিত্য সম্পর্কে। শব্দ শব্দ ধরে মার্গারিট সুনীলকে শিখিয়েছেন ফরাসী কবিতার অর্থ।
আত্মজীবনীমূলক বইটিতে সুনীল উল্যেখ করেছেন মার্গারিটের সাথে তার বোঝাপড়ার কথা। একজন সমৃদ্ধ সাহিত্যিক হতে হলে তাকে যে আমেরিকা ছেড়ে কোলকাতায় ফিরতে হত সেটা মার্গারিটও মানতেন। বইটির শেষ দিকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্বীকার করেছেন, মার্গারিট তাকে ভালবেসে কোলকাতায় অলিয়স ফ্রোজে��ে চাকুরী নিয়ে আসতে চেয়েছিল। এছাড়াও প্রথম দিকেই তিনি উল্যেখ করেছেন বিখ্যাত সব অ্যামেরিকান কবিদের সাথে আড্ডার গল্প, যার মধ্যে এ্যালেন্স গিনসবার্গ অন্যতম। ১৯৭১ সালে এ কবির লেখা September on Jessore road বাঙালী জাতীর আত্মার গল্প।
বইটিতে প্রতি পরিচ্ছেদ শুরুতে বিখ্যাত সব কবিদের কবিতার অনুবাদ দিয়ে শুরু করেছেন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এরপরে এনেছেন ভ্রমণ ও চিত্রশিল্পের বর্ণনা। চিত্রশিল্পের বর্ণনায় উঠে এসেছে সতেরো, আঠারো শতকের বিখ্যাত সব চিত্রশিল্পীদের কথা। বইয়ের মধ্যেও রঙিন কাগজে আনন্দ পাবলিশার্স ছাপিয়েছে ইম্প্রেশোনিজম আন্দোলনের সদস্যদের গভীর সব চিত্রকর্ম। চিত্রকে টানতে গিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন রেনোয়া, এ্যাডওয়ার্ড মানে, গ্যগা, পিকাসোদের বিখ্যাতসব চিত্রকর্ম আর তার চিত্রপটের বর্ণনা। ফরাসীদের ইতিহাস থেকে শুরু ইউরোপের ব্রিটিশদের আগমন এমনকী নেপোলিয়নের বর্ণনা করেছেন তিনি।
দীর্ঘদিন মার্গারিটের খোঁজ পাননি সুনীল, এরপরে বিয়ে করেছেন স্বাতি গঙ্গোপাধ্যায়কে। মজার ব্যাপার হল মার্গারিটের প্রতি স্বাতির শ্রদ্ধা ছিল বোঝা যায়, লেখক আত্মজীবনীমূলক বইটিতে তুলে ধরেছেন তার ব্যক্তিজীবনের সেসব গল্পও। ফরাসী ভাষা জানা স্ত্রীকে নিয়ে পরবর্তিতে তিনি ফ্রান্স ভ্রমণ করেছেন লিখেছেন সে বিষয়েও। উল্যেখ করেছেন ফ্রান্সে তাদের বন্ধুদের কথাও। বইটির এভাগে তিনি এমন কিছু তথ্যযোগ করেছেন যা অনেকটা পাঠ্যবইয়ের মত। যেমন ফরাসীদের যুদ্ধ, ইম্প্রেশোনিজম আন্দোলনের বিষয়বস্তু, নেপোলিয়নের গল্প এবং সমৃদ্ধ কবিদের কবিতা নিয়ে সাহিত্য আলোচনা। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে বলেছেন ভ্রমণকাহিনীও।
মাঝের পরিচ্ছেদে তিনি একবার টেনে নিয়েছেন মার্গারিটের সাথে তার ফ্রান্স ভ্রমণের গল্পও, বইটিতে সুনীল অকপটে স্বীকার করেছেন তাদের এক সাথে থাকার কথা, ফ্রান্স জুড়ে জগতবিখ্যাত মিউজিয়াম আইফেল টাওয়ারে ওঠা নিয়ে মার্গারিটের অনাগ্রহও লিখেছেন তিনি। পরবর্তি আরো কয়েক পরিচ্ছেদে তিনি লন্ডন ও প্যারিস প্রবাসি বন্ধুদের সাথে উত্তর ফ্রান্সের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতিচারণ করেছেন।
বইটির শেষ দিকের কিছু কথা এমন যে শিল্প সাহিত্য এখন হয়ে গেছে নিউইয়র্ক কেন্দ্রিক বিশ্বের সেরা সব আর্ট গ্যালারী সব সেখানে অথচ একটা সময় বৈশ্বিক শিল্পের কেন্দ্র ছিল ফ্রান্স। ডেনমার্কের এক কবি তাকে বলেছিলেন তার বই দুশো কপি বিক্রি হলেই তিনি সার্থক, কারণ শিল্প সাহিত্য এখন আর ইউরোপে নেই সেটা গরীবদের খাদ্যে পরিণত হয়েছে। ভারত বাংলাদেশে এসব নিয়ে মাতামাতি হয়! সত্যিই যদি তাই হত তবেই হয়েছিলো। সুনীল বেঁচে নেই, থাকলে আজ লিখত ছাপাখানার প্রসারতা বাড়লেও সাহিত্য বাড়েনি। তাই হয়ত 'ছবির দেশে কবিতার দেশে'র মত বইটি নিয়েও এখন তেমন কেউ মাতে না। বাংলাদেশেও আজ দুয়েকশ কপি বই বিক্রি হলেই নিজেকে সার্থক মনে হয়।
নিজস্ব মতামতঃ
রিভিউটি লেখার আগে দেখলাম বইটি নিয়ে খুব বেশি সমৃদ্ধ আলোচনা নেই। অথচ বইটি অনেকেই পড়েছেন। এমন একটি বই যা ভ্রমণ, সাহিত্য, ইতিহাস, চিত্রশিল্পের তথ্য সমৃদ্ধ। বইটি আগ্রহের পাঠ্যসূচীতে যুক্ত হলে এ যুগের বিসিএস পড়ুয়ারা গিলে খেতো। সে যা হোক, যে কথা শুরুতে বলছিলাম, এক কথায় আলোকপাত করে এই বইয়ের রিভিউ করা সম্ভব নয়।
বইপোকাদের গ্রুপে মাঝে মাঝে পোস্ট দেখি, আউটবই পড়বো নাকি টেক্সট বই! আউট বই বলতে তারা এসব বইকেই বোঝান। এইসব টেক্সটবুক পাঠকদের টেনে এনে যদি এমন সব বই পড়ানো সম্ভব হয় তবেই মৌলিক স��হিত্যের ধাঁরা যেমন সমৃদ্ধ হবে তেমনি গল্পে গল্পে কীভাবে নিজেকে সমৃদ্ধ করা যায় তাও সাধন হবে।
শেষ করবো বইটিতে উল্যেখিত ভলতেয়ারের দারুণ এক উক্তি দিয়ে,
I love physics so long; I did not try to take precedence over poetry. Now that it is crushing all the arts, I no longer wish to regard it as anything but a tyrant.
রেটিং: নাহ, এসব বইয়ের রেটিং দিতে পারব না। -
নাম শুনেই আঁচ করে নেয়া যায়, বইটি ফরাসী দেশকে কেন্দ্র করে লেখা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর পাঁচবারের ফ্রান্স ভ্রমণের গল্প এটি।
বইতে ভ্রমণের পাশাপাশি ফ্রান্সের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, প্রকৃতি, শিল্প বেশ স্পষ্ট করে জানা যায়। সুনীলের জীবনের গভীর এক সম্পর্কের বিশদ বর্ণনাও আছে বইটিতে। প্রেম, বিরহ, পাওয়া না পাওয়ার কত গল্প! তাই এটা অনেকটাই আত্বজীবনিমূলকও। ফরাসী তরুনী মার্গারিটের কারনেই এই বইটি এতটা আকর্ষন জাগানিয়া। সুনীলেরও ফরাসী সাহিত্য ও শিল্পকে এত বেশি ঘনিষ্ঠ ভাবে চেনা জানা হয়েছিল মার্গারিটের কারনেই।
ফরাসী দেশ সম্পর্কে সহজ বাংলায় মূল ধারনা নিতে চাইলে এই বইটি আদর্শ।
আমার খুব প্রিয় বই এটি। ২০২১-এ পড়া সবচেয়ে প্রিয় বইগুলোর একটি।
বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতে আছে কোনো একটা ফরাসী কবিতার অনুবাদকৃত কিছু কিছু অংশ। যার অনুবাদ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ই করেছেন মার্গারিটের সহযোগীতায়।
সুন্দর বই! -
মানুষের অনেক ক্ষমতা। সে নিজের আঙুল কামড়ে খেয়ে ফেলার মত ক্ষমতা রাখে, কিন্তু মস্তিষ্ক ও কম জাঁদরেল নয়। সহজাত আত্মরক্ষা প্রবৃত্তির দরুণ মস্তিষ্ক কখনই মানুষ কে তার এই ক্ষমতার যথেচ্ছাচারের সুযোগ টা দেয় না।
এবং আমি নিশ্চিত যে আমি যদি এই মুহুর্তে নিজের আঙুল কামড়ানো শুরু করি মস্তিষ্ক আমাকে এতোটুকু বাঁধা প্রদান করবে না কারণ এই বইটার হার্ডকপি না পড়ে সফট কপি পড়ার জন্য মহামান্য মস্তিষ্ক আমার উপর যারপরনাই বিরক্ত। যাহোক রিভিউ লেখার পর এই কামড়ানোর ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করবখন।
সুনীল আমার খুব মতান্তরে সবচেয়ে প্রিয় লেখক। তবে কেন ৪ তারা? কারণ তাঁর কাছে আমার প্রত্যাশা অনেক। নিঃসন্দেহে বইটা ৫ তারার উপযোগী। কিন্তু ১ তারা কম দেওয়ার কারণ কিছু কিছু ব্যাপার(যদিও খুব অল্প) তিনি বইতে এক এর অধিক বার উল্লেখ করেছেন। কি ভাবছিলেন লেখক? পাঠক বইয়ের মাঝামাঝি গিয়ে প্রথম অধ্যায় এর কাহিনী ভুলে যাবে? তা যদি তিনি ভেবে থাকেন তবে তিনি তাঁর পাঠকদের একনিষ্ঠতাকে মাঝারি করে দেখেছেন।
বইয়ে ভাল লাগার বিষয় গুলোঃ সবটুকুই।(হার্ডকপি যেদিন পড়ব তারপর লিখব এই অনুচ্ছেদটা।)
প্যারিসে যাওয়ার ইচ্ছা সব সময়ই ছিল। সবারই থাকে। বইটা পড়ার পর ইচ্ছাটা স্বপ্নে রূপান্তরিত হয়েছে।
বইটা না পড়লে যে জীবন বৃথা হয়ে যাবে এমন নয় তবে প্যারিস বা ইউরোপ ভ্রমণের পূর্বে বইটা না পড়লে আপনার ভ্রমণ কখনোই সম্পূর্ণ হবে না। আর যারা কবিতা পড়তে বা লিখতে ভালবাসেন তাদের জন্য এই বইটা অবশ্য পঠিতব্য। (মার্গারিটের মত একজন কবিতাপ্রেমী সঙ্গী কোন কাব্যপ্রেমীই না চায় জীবনে?আর ফরাসি কবিতাগুলোর সুনীলিয় অনুবাদ যেকোন কবিতা লেখক এর চেতনায় অনুনাদ সৃষ্টি করতে বাধ্য)
সিদ্ধান্তের পরিবর্তনঃ আঙুল কামড়ানোর ব্যাপারটা আপাতত হার্ডকপি হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় রইল। (এটা মস্তিস্কের নতুন কোন ষড়যন্ত্র মূলক চাল কিনা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না) -
এই মুহূর্ত থেকে মার্গারিটকে ভালবাসা শুরু করলাম। সেটা কখনো শেষ হবে না।
-
The writer gives a vivid description of French cities, tourist spots, cafes, arts, writers, poets and so on. And he brings forth his relationship with a French girl throughout the book. A great read for someone curious about French culture which I assume most people are.
-
সাঁতার কাটতে শেখার প্রথম দিনগু��োতে পুকুরের বাঁধানো ঘাটের পিচ্ছিল ধাপগুলো ধরে পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে নিজেকে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম। কিছুদিন পরে সাহস একটু ডাগর হলো, তখন একটা খালি তেলের কনটেইনার বুকে চেপে ভেসে যেতাম একটু দূরে। এইভাবে ছোট ছোট ভীরু পদক্ষেপ(নাকি নিক্ষেপ?) এর পর সাঁতার শিখেছি বটে, তবে শীর্ণ শরীর নিয়ে এখনো বেশীক্ষণ উপুড় হয়ে সাঁতরাতে পারি না। একটু আধটু চেষ্টা করেই চিৎ সাঁতারের শরণ নিতে হয়।
এ বইয়ের সাথে সাঁতারের সম্পর্ক বলতে দু' জায়গায় বর্ণনা আর আস্ত একটা ফটোগ্রাফ।
মূলত যে কারণে এইসব ভণিতা তা হলো, সাঁতার কাটতে শেখার সাথে নিজের পাঠক জীবনের যতোটা মিল খুঁজে পাই আর কিছুর সাথে তেমনটা পাই না। পাঠক হিসেবে শুরুর দিকে কিশোর উপন্যাস, থ্রিলার এসবের বাইরে যাই নি অনেক দিন। বই কিনতে না পারার সেসব দিনগুলোর বড় একটা অংশ কেটে গেছে এর কাছে ওর কাছে নতুন কোনো বই না পাওয়ার হা-পিত্যেশে। আরো লম্বা একটা সময় কেটে গেছে 'গভীরে' যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সাহসের অভাবে।
যাহোক, সেভেন এইটে পড়াকালীন সময়ে হুমায়ূন পড়া শুরু করলাম। তখন এক বইভাই(দা) বেশ চাপাচাপি করেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পড়ার জন্য। আমি কর্ণপাত করি নি। কারণটা খুবই সরল এবং উৎকট। গঙ্গোপাধ্যায় উপাধিটা আমার কাছে বিচ্ছিরি মনে হতো। যার নামই এমন খটমটে, তার লেখা যে সুবিধার হবে না এ ব্যাপারে আমি একদম হালফিল ছিলাম। উপরন্তু তখন হচ্ছে চুটিয়ে তিন গোয়েন্দা, কুয়াশা আর মাসুদ রানা পড়ার বয়েস।
একদিন পড়ার মত কোনো বই না পেয়ে বাপের বাদামী মলাটের হিবিজিবি বইয়ে ভর্তি শেলফে পেয়ে গেলাম মলাটবিহীন একটা বই। নাম: 'ছবির মানুষ', লেখক: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
অনেকদিনের ভুখা আমি তক্ষণে কঙ্কর চিবুতে রাজী, আর এ তো কোন খটমটে গঙ্গোপাধ্যায়। পড়ে ফেললাম। ব্রিটিশ আমলের বিপ্লবীদের স্বাধীনতাত্তোর কালের জীবনের এক চিমটি নিয়ে লেখা উপন্যাস। এ বইয়ের নাম আমি আর কারো কাছে শুনি নি। তিন বছর ধরে নীলক্ষেত-পল্টন-অনলাইন এই বই সেই বইয়ের খোঁজে চষে বেড়াচ্ছি তবুও কখনো বইটির চেহারাটুকু দেখি নি। সেই যাই হোক, আমার বলতে দ্বিধা নেই ওই বয়সে সুনীল শুরু করার জন্য এর চাইতে ফালতু বই আর হয় না।
তারপরে একে একে পড়া হয়েছে জলদস্যু, রানু ও ভানু, মনের মানুষ, রাধাকৃষ্ণ। কিন্তু সুনীলের আমাকে আর ধরা হয়ে ওঠে নি।কে না জানে, সঠিক সময়ে সঠিক বই না পড়ার জ্বালা রাবণের চিতার মত চিরস্থায়ী এবং এতে 'Better late than never' ব্র্যান্ডের পানি ঢেলে কোনো লাভ হয় না।
তাই বই নিয়ে বকবক করতে দেখে যখন কেউ জিজ্ঞেস করে সুনীলের সময় ট্রিলজি পড়েছি কি না, উত্তরে যখন আমি বলি, 'না'; প্রশ্নকর্তার চেহারাখানা দেখার মত হয়। মনে হয় আমি শত আলোকবর্ষ দূরের কোনো মানুষ, আর উনি চোখ বাঁকিয়ে, কুঁচকে হাবল টেলিস্কোপ দিয়ে আমাকে দেখার চেষ্টা করছেন।
এই হলো গিয়ে আমার সুনীল-যাত্রা। বাকি সবার মত জীবন ছুঁয়ে যাওয়া নয���, সুবিধার তো নয়ই। যাহোক, শিফাতের সুনীল নিয়ে নিরবিচ্ছিন্ন বকবকানিতে আর স্পয়লার খেয়ে যাওয়ার ভয়ে একরকম অনিচ্ছাসত্ত্বেই আমি 'ছবির দেশে, কবিতার দেশে' নিয়ে বসলাম।
ছবি ও কবিতা এই সূত্র দিয়ে যদি কেউ কোনো দেশের নাম খুঁজতে বলে, সবাই চোখ বুজে আঙুল তুলবে ফরাসী দেশের দিকে। অবশ্যই এটা ফ্রান্স ভ্রমণের কথা, সেই সাথে চিলতে এঁটে গেছে লেখকের আমেরিকা ভ্রমণকথাও। কবি-সাহিত্যিকরা সারাজীবন নিজের অভিজ্ঞতাই ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে বিক্রি করে খায়, সেইখানে নিজেদের অভিজ্ঞতার সরাসরি বর্ণনা যেখানে আছে, সেই ভ্রমণকাহিনী আর আত্মজীবনী তো অন্যরকম সুষমা ধারণ করার কথা। অন্তত আমার তাই মনে হয়। ভ্রমণের বর্ণনা সুনীলের মতই , অনেক বেশী সুন্দর আর ছবির মতন। তবে বইটার মূল আবেদন বুঝি পরিমিতিবোধে। ফরাসী চিত্রকলার অ আ ক খ নিয়ে আলাপ আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। পষট করে আলাপ বলতে ইতিহাস আর বিখ্যাত আর্টিস্টদের নিয়ে জানাশোনা আরকি। সাঁইত্রিশটা চ্যাপ্টারের প্রতিটার শুরুতে একটা করে কবিতা সেঁটে দেওয়া। কখনো রেনে গী কাদু, কখনো গীয়ম আপোলোনীয়ার, আর অতি অবশ্যই দুঃখ-ক্লেদের বরপুত্র শার্ল বোদলেয়ার। কবিতা নিয়ে আলাপ পরতে পরতে মিশে আছে। আছে কলকাতার কথাও, এ বোধহয় এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। সবই আছে, কোনোকিছুর কমতি নেই, কোনোকিছুর আতিশয্যও নেই। অসীম আর ভাস্করের সাথে ভ্রমণের অংশগুলো অনেক বেশী প্রাণবন্ত মনে হয়েছে। সুনীলের আলাপ আসলে, ছবির দেশে কবিতার দেশের আলাপ আসলে ঘুরেফিরে মার্গারিট আসবেই। অদ্ভুত দ্বৈততা নিজের মধ্যে ধারণ করা মার্গারিট বইয়ের যে কয়টা পেইজ জুড়ে ছিলো সেটুকু অন্যরকম ঝলমলে ছিলো। তারপরেই অবশ্যম্ভাবী সুর-পতন। বই শেষ করতে করতে ভাবছিলাম একজন লেখককে এরকম বই সমাপ্তি টানতে কতটুকু বিষাদ চেপে রাখতে হয়। এইসব অনুষঙ্গই হয়তো বইকে আরেকটু অকপট করে তোলে।
অনেকদিন কোনো বই শেষ করা হচ্ছিলো না। কিনছি, নাড়াচাড়া করছি, শুরু করছি কিন্তু কোনোটাই আর শেষ করা হয়ে উঠছিলো না। অবশেষ সুনীল ত্রানকর্তা হিসেবে আসীন হলেন। সুনীল, আমার পাঠকজীবনের ছোট্ট পুকুরে আপনি বাঁধানো ঘাট হয়েই থাকুন। মাঝপুকুরে সাঁতার কাটতে কাটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে চিৎসাঁতারে ফিরে ফিরে আসবো। -
বইমেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছি হটাৎ একজন ডেকে বললো, সাগর অন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে অামেরিকায় একটা অনুষ্ঠান হবে। বাংলাদেশ থেকে তুমি যাবে? যাওয়া-অাসা, থাকা-খাওয়া যাবতীয় খরচ কতৃপক্ষ বহন করবে। বিভিন্ন দেশ থেকে সাহিত্য প্রেমীদের একটা মিলন মেলা বসবে। এক বছর যাবৎ সবাই একসাথে থেকে বিভিন্ন দেশীয় সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ কাজে সাহায্য করবে। তুমি কি যেতে চাও? অামি অাগে পিছে না ভেবে বলবো হ্যা।
উপরোক্ত ঘটনা অামার সাথে অনেকবার ঘটেছে কিন্তু স্বপ্নে। বাস্তবে যার সাথে এমনটি হয়েছিলো তিনি হলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ছবির দেশে কবিতার দেশে বইটি পড়ে অন্তত এটাই জানতে পেরেছি। তারপর প্লেনে চড়ে অামেরিকা। এরপর বিটবংশ ও গ্রিনিচ গ্রামের কবিদের সাথে মিলনমেলা। যেখানে ছিলেন অ্যালেন গিন্সবার্গ, পিটার অরলোভস্কি, পল ওঙ্গেল। সুনীল বাবুর সেই অামেরিকা যাওয়ার পথে ট্রানজিটে নেমেছিলেন ফ্রান্সে। তারপর অারো পাঁচবার গিয়েছিলেন শিল্প সংস্কৃতির অাতুরঘর ফ্রান্স নগরীতে। বেশ কিছুদিন কাটিয়েছিলেন অামেরিকায়। বইয়ে সেইসব ভ্রমণ অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেছেন তিনি। মূলত ভ্রমণ অভিজ্ঞতা থেকে শিল্প সংস্কৃতিকে খুঁটিয়ে দেখা বললে বেশি সঠিক হয়।
বইয়ের অাসল কাহিন এগিয়েছে ফ্রান্সের মেয়ে মার্গারিট এবং বাঙালি বাবু সুনিলের মধ্যে ঘটনা উপঘটনাকে কেন্দ্র করে। দুজনের সাহিত্য প্রীতি ছিলো অন্তর থেকে। অার তাই ভাব জমে গিয়েছিলো। বন্ধুত্ব গড়ে উঠে, অার জমে উঠে গল্প অাড্ডা। সবকিছুর বিষয় বিশ্ব সাহিত্য, কোন দেশের কে কেমন লেখে, কার লেখা কেমন লাগে, কোন কবি কবিতায় কি বলেছেন, অার্ট নিয়েও নানা বিষয় উঠে এসেছে তাদের কথোপকথনে। একসময় মার্গারিট হারিয়ে যায়, বইয়ের কাহিনী চলতে থাকে। কিন্তু অামার মন উৎসুক হয়ে খুঁজতে থাকে মার্গারিটকে। এমন একজন বন্ধু না পাওয়ার অাক্ষেপ সারাজীবন থেকে যাবে মনে।
এই বই নিয়ে লিখে বলা দুষ্কর। একটা স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে রেখেছিলো বইটি। ইট কংক্রিটের এই শহরে নিজের বিছানায় শুয়ে কল্পনা শক্তিকে জাগ্রত করে ইউরোপ অামেরিকা ঘুরতে চাইলে এই বই অাপনার জন্য। বইটি অামার নিজের একটা কল্পনা জগৎ তৈরি করে দিয়েছিলো, যেখানে অামি অামেরিকা অার ফ্রান্স ঘুরেছি, সাথে অাছে মার্গারিট। দুজন মিলে বিশ্বসাহিত্য নিয়ে অাড্ডায় ঝড় তুলছি। কত কত বিশ্ব বরেণ্য মানুষদের সাথে কথা বলেছি, তাদের জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। অামি স্বপ্নে দেখেছি, অাপনিও দেখতে পারেন।
বইঃ ছবির দেশে কবিতার দেশে
লেখকঃ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
প্রকাশনীঃ অানন্দ পাবলিশার্স
মূল্যঃ তিনশত রূপি -
কবি ও লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে তো আর নতুন করে পরিচয় করে দেওয়ার কিছু নেই। আর সব লেখাকে বাদ দিলেও তাঁর সময় ট্রিলজির জন্যই তিনি বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকবেন। আর এই লেখকেরই এক অসাধারণ ভ্রমণ কাহিনি হল 'ছবির দেশে কবিতার দেশে'।
সঞ্জীবচন্দ্রের পালামৌ, মুজতবা আলীর দেশে ব��দেশে বা বুলবুল সরওয়ারের ঝিলম নদীর দেশের পর আরেকটি অসাধারণ ভ্রমণকাহিনী পড়া হল বইটার মাধ্যমে। লেখকের ৫ বার ফ্রান্স ভ্রমণ ও যাত্রাপথের অন্য কয়েকটি দেশের ভ্রমণ ইতিবৃত্ত নিয়েই রচিত হয়েছে বইটি। কিন্তু বইটি যেন নিছক কোনো ভ্রমণকাহিনীর চেয়ে বেশি কিছু, এতে একাধারে স্থান পেয়েছে শিল্প, সাহিত্য, ভ্রমণ, স্থাপত্য, রোমাঞ্চ, ইতিহাস সবই, কখনো হয়ে উঠেছে আত্মজীবনী।
কিন্তু মনে হতেই পারে ফ্রান্সে ভ্রমণকাহিনীর বইয়ের নাম এমন কেন, তার জবাব পাওয়া যায় বইয়ের প্রতিটা পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। অগণিত শিল্প সাহিত্যিকের লীলাভূমি ফ্রান্সে ভ্রমণে প্রতিটা পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় উঠে এসেছে র্যাবো, ভারলেইন, বোদলেয়ার, ভলতেয়ার, রুশো, মালার্মো, অ্যাপোলিনিয়ারদের কবিতা, তাঁদের জীবন; পাশাপাশি রয়েছে মোনে, দেগা, মানে, রেনোয়া, গগাঁ, পিকাসো, ভিঞ্চিদের কথা তথা ছবির কথা। তাইতো ফ্রান্সে ভ্রমণ তো কবিতারই কথা, ছবিরই কথা।
বইটা ভ্রমণকাহিনী হয়েও যেকারণে বইটাকে রোমান্টিক উপন্যাস বলে বোধ হয়, তাঁর কারন মার্গারিট ম্যাতিউ চরিত্রটি। স্বর্ণকেশী এক কবিতা ও শিল্পপাগল ফরাসি মেয়েটি অল্প কয়েকটা পৃষ্ঠা জুড়ে থেকেও প্রবলভাবে আছে পুরো বইজুড়ে। ওর সাথে প্রথম দেখা হওয়া, ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দেওয়া, এক রুমে অসংখ্যবার রাত কাটিয়েও অনেক দূরে থাকা, আবার সামান্য দূরে গিয়েও প্রবলভাবে মিস করা, এক সাথে পুরো ফ্রান্স চষে বেড়ানো আর ফ্রান্সের শিল্প, সাহিত্যকে বোঝার ব্যাপারগুলো ছিল অনবদ্য। আবার ওর পরিণতিটা যেন চোখে পানি এনে দেয় আর লেখকের বারবার ফ্রান্সে ফিরে যাওয়া যেন ওর কাছেই ফিরে যাওয়া বলে বোধ হতে থাকে। এভাবে দেশে বিদেশের আব্দুর রহমানের মতো বইয়ের মার্গারিট চরিত্রটাও হয়ে দাঁড়ায��� ভ্রমণকাহিনীর প্রধান আকর্ষণে।
অন্যদিকে প্রতিটা অধ্যায়ের শুরুতে অসাধারণ সব ফরাসি কবিতার অনুবাদ, মার্গারিটের সাথে ভ্রমণের সময় কবিতাময় মুহূর্তগুলো, বিখ্যাত সব কবি, শিল্পীদের মজার ও করুণ সব কাহিনী, বন্ধু অসীম, ভাস্কর, বাদলের সাথে ভ্রমণের মজার সব অভিজ্ঞতা এসবই বইটাকে দিয়েছে অনন্য মাত্রা। তাইতো বইশেষেও আব্দুর রহমানের মতো আমাদের মার্গারিটের জন্য মন কাঁদে, ঝিলম নদীর দেশ পড়ে তাৎক্ষণাৎ কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ার মতো তাৎক্ষণাৎ ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়তে মন ব্যাকুল হয়। -
নীললোহিত নামের চেয়ে সুনীল নামটাই শ্রেয় ছিলো তাঁর জন্যে। অবশ্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নামেই নামডাক। যেকোনো লেখকের গুরু লঘু নামের কারণে আমরা অনেকেই কাছের করে নিতে পারি। তেমনি সুনীল আমার কাছের হয়ে উঠেছেন "ছবির দেশে, কবিতার দেশে" বইটা পড়ার পরে।
পারী বা প্যারিস শহর টা আমার কাছে "ড্রিম সিটি" ছিলো। প্যারিস যে কবে আমার খুব পছন্দের হয়ে উঠলো তা বলতে পারবোনা। এই বইটা আমার পছন্দের জায়গাটা পাকাপোক্ত করে দিয়েছে।
সুনীল যে কিভাবে একজন লেখক হয়ে বিদেশ ভ্রমণের প্রথম সুযোগ পেয়ে আমেরিকা দিয়েছিলেন এটার বর্ণনা খুবই আনন্দ দিয়েছে। আমেরিকায় কতশত মানুষের সাথে পরিচয়, কত আড্ডা, শান্তিময় জীবন তবুও সুনীলের ভালো লাগছিলো না কিছু সময় যাওয়ার পরে। তারপর পরিচিত হয়েছে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরানো একটা চ্যাপ্টার "মার্গারিট"। আহা! এখন ভাবতেই মনে শিহরণ জাগাচ্ছে। বই, আড্ডা, ভ্রমণ, লেখক - কবি, দর্শন, সাহিত্য, ইতিহাস আর কোন বিষয় তাঁরা বাদ দিয়েছেন কী। এমন গভীর আলোচনায় তো দুইজন মানুষের প্রেম হয়ে যাওয়ার কথা। তাঁদের মধ্যে যা ছিলো তা প্রেমের উর্ধ্বে। সবকিছু চাপিয়ে আমার কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে মার্গারিট - সুনীল। মার্গারিট আর সুনীল এর একসাথে প্যারিস গিলে ফেলা আমার প্রিয় অধ্যায় হয়ে গেছে।
আরেকটা ইন্টারেস্টিং বিষয় ছিলো সুনীলের সাথে অ্যালেন গিন্সবার্গ এর মুহুর্তগুলো। আমি ভাবতেছিলাম, সুনীলের জায়গায় একজন সাধারণ বাঙ্গালী হলে তার রেসপন্স কেমন হতো।
সুনীলের কাছে ফ্রান্স আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠায় বারবার ছুটে যান। এভাবে তাঁর ভ্রমণকাহিনী বলে যান গল্পের মতো যেনো মনে হচ্ছিলো আমি ভরা মজলিশে সুনীলের মুখে বুলি শুনতেছি।
সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ছিলো চ্যাপ্টার ভিত্তিক কবিতা যোগ করা। সুনীলের অনুবাদে বেশ আবেশে টেনে নিয়েছিলো কবিতাগুলো।
আমি শেষ পর্যন্ত মার্গারিটের অপেক্ষায় ছিলাম। কোনো একটা দৈববলে একটাবার তাঁর দেখা পাবো। তাঁর বয়স ওখানেই আটকানো। চিরযৌবনা।
কষ্টের বিষয় ছিলো আমার জন্যে যে, আমি ইপাব পড়েছিলাম। আমার কাছে বই নেই। বইটা খুব শীঘ্রই কালেকশনে রাখবো।